Hero Image

একই এলাকার সব জায়গায় বৃষ্টি না হওয়ার কারণ কী?

Getty Images

এপ্রিল জুড়ে টানা তাপপ্রবাহের পর অবশেষে গতকাল দোসরা মে রাতে স্বস্তির বৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলছেন, ঢাকার সব জায়গায় গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়নি। এমনকি, কেউ কেউ বলছেন যে একই এলাকার কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, কোথাও আবার একদমই বৃষ্টি হয়নি।

ঢাকার সব এলাকায় আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র না থাকায় তারা পুরোপুরি সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি যে কোন কোন এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে, কোন কোন এলাকায় হয়নি।

অথবা, একই এলাকার কোন অংশে বৃষ্টি হয়েছে, কোন অংশে একদমই বৃষ্টির দেখা মেলেনি।

তবে আবহাওয়াবিদরা এটি নিশ্চিত করেছেন যে বজ্রবৃষ্টির সময় একই এলাকার কিছু অংশে বৃষ্টি হলেও অপর অংশ বৃষ্টিহীন থাকার মতো ঘটনা ঘটতেই পারে। কারণ এটাই ‘বজ্রবৃষ্টির ধর্ম’।

কিন্তু, বজ্রবৃষ্টির এমন ধর্ম বা আচরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী?

Getty Images এপ্রিল জুড়ে তাপপ্রবাহের পর বৃষ্টিতে খুশি সবাই। বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
  • বৃষ্টি আসছে, গরম কমবে এবার?
  • একই এলাকার সর্বত্র বৃষ্টি না হওয়ার কারণ

    আকাশে যখন তীব্র বজ্রমেঘ তৈরি হয়ে যায়, তার গঠন থাকে ত্রিমাত্রিক। ঢাকার সব জায়গায় বৃষ্টি না হওয়ার সাথে ঢাকা শহরের আয়তন ও বজ্রমেঘের এই ত্রিমাত্রিক গঠন সম্পর্কিত।

    আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে জানান, একটি তীব্র বজ্রমেঘের দৈর্ঘ্য সাধারণত ২২ থেকে ২৪ কিলোমিটারব্যাপী হতে পারে। এর চওড়া বা প্রস্থ হতে পারে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। এছাড়া, মাঝারি বা ছোট বজ্রঝড়ের উচ্চতা হয় আট থেকে ১২ কিলোমিটার। বড় বজ্রঝড়ের উচ্চতা ১৮ থেকে ২২ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

    “অর্থাৎ, বজ্রমেঘের ত্রিমাত্রিক গঠন থাকে। রকম একটি ত্রিমাত্রিক শক্তিশালী বজ্রঝড় অগ্রসর হওয়ার সময় তার আয়তন কম বেশি হতে পারে,” বলেন মি. মল্লিক।

    ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ১৭৮ বর্গ কিলোমিটার। সেইসাথে, শহরের দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত দূরত্ব আনুমানিক ২২ কিলোমিটার এবং পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার।

    “অর্থাৎ, ঢাকা একটি লম্বা শহর। সুতরাং, ঢাকার ২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মাঝ দিয়ে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার চওড়া হয়ে একটি বজ্রঝড় যখন যায়, তখন সে শহরের সবটুকু দৈর্ঘ্যকে কাভার করে না।”

    সাধারণত বজ্রঝড়ের গতিবেগ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে, অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হয়।

    “এর মানে, বড় লম্বা একটা জায়গার মাঝ দিয়ে কম চওড়া একটি জিনিস যাচ্ছে।”

    বজ্রঝড়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- এটি সরল পথে না, আঁকাবাঁকা পথে চলে।

    “যেহেতু সে জিগজ্যাগ বা স্পাইরাল মুভমেন্ট করে এবং শহরের মাঝে অনেক স্থাপনা থাকার কারণেবা পাহাড় থাকলে বাতাস বিভিন্ন জায়গায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দিক পরিবর্তন করে; তাই, বজ্রঝড় অগ্রসর হওয়ার সময় সে কোনও এলাকাকেই পূর্ণরূপে কভার করতে পারে না। সেই কারণে, কোথাও কোথাও তাণ্ডব কম হয়, কোথাও বেশি হয়। কোথাও বৃষ্টিপাত বেশি, কোথাও বৃষ্টিপাত হয় না। ভূমিরূপ বা টপোগ্রাফি অব দ্য আর্থ সারফেস এখানে গুরুত্বপূর্ণ,” যোগ করেন মি. মল্লিক।

    Getty Images ঢাকার সব জায়গায় বৃষ্টি না হওয়ার সাথে ঢাকা শহরের আয়তন ও বজ্রমেঘের এই ত্রিমাত্রিক গঠন সম্পর্কিত। বজ্রঝড় কেন পূর্বেই ধাবিত হয়

    একটি কম শক্তিশালী বজ্রমেঘের গতিবেগ সাধারণত ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার হয়ে থাকে। মাঝারি আকারের বজ্রঝড়ের গড় গতিবেগ ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। যেটি আবার তীব্র বজ্রঝড়, তার গতিবেগ ৮০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্তও হয়ে থাকে।

    বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় যে বজ্রঝড় হয়েছে, তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার।

    আবহাওয়াবিদ ড. মল্লিক বলেন, “ধরা যাক, আগারগাঁও বরাবর বজ্রঝড় সৃষ্টি হলো। সে যাবে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে। সেক্ষেত্রে সে গুলশান, বনানীতে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু সে তো মিরপুরের দিকে আঘাত হানবে না…তার আনুভূমিক যাত্রা যেদিকে, সেদিকেই ঝড় হয়। অন্যদিকে হয় না।”

    “ত্রিমাত্রিক গঠনের বৈশিষ্ট্যের কারণে বজ্রঝড় বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত হতে পারে না। বজ্রঝড়ের বৈশিষ্ট্যই এমন। এজন্য একে বলে হাইলি লোকালাইজড থান্ডারস্টর্ম।”

    এই আবহাওয়াবিদ আগেই বলেছেন যে বজ্রঝড় সাধারণত পূর্ব দিকেই ধাবিত হয়। এর কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেন— “বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের অভ্যন্তরে যে পশ্চিমা লঘুচাপ তৈরি হয়, সেটি বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়া মানে বায়ুচাপ কম থাকা।”

    “বায়ুচাপ কম থাকলে চারিদিক থেকে জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাস ওই লঘুচাপের দিকে ধাবিত হয়। তখন আরব সাগর থেকে ওই লঘুচাপের দিকে বাতাস আসে। আবার, বঙ্গোপসাগর থেকেও আসে। দুই সাগরের জলীয় বাষ্প যখন পশ্চিমবঙ্গে এসে সম্মিলিত হয়, তখন তা উপরের দিকে ধাবিত হয়। উপরের দিকে যাওয়ার পরে বাতাসে যে জলীয় বাষ্প থাকে, তা মেঘমালা তৈরি করে।”

    এছাড়া, এসময় ঊর্ধ্ব আকাশে যে বাতাস প্রবাহিত হয়, তা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়।

    “বজ্রঝড় তৈরি হওয়ার পর সে মেঘকে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাওয়ার জন্য ঠেলে। আবার ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাসও পূর্ব দিকে যায়। তাহলে একটি বজ্রঝড় পশ্চিম থেকে পূর্বেই যাবে।”

    Getty Images বাংলাদেশে মে মাসে সাধারণত গড়ে ১৩ দিন বজ্রঝড় হয়। বিবিসি বাংলার আরও খবর: মে মাস জুড়ে বজ্রপাত, তাপপ্রবাহ ও বন্যা

    গতকাল বজ্রবৃষ্টি পর বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ জন নিহত হওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। পুরো মে মাস জুড়েই এরকম বজ্রঝড় অপেক্ষা করছে।

    আবহাওবিদ ড. মল্লিক জানান যে বাংলাদেশে মে মাসে সাধারণত গড়ে ১৩ দিন বজ্রঝড় হয়। এখন পর্যন্ত এই মাসে সর্বোচ্চ ১৮ দিন পর্যন্ত বজ্রঝড় হওয়ার রেকর্ডও আছে।

    “তাই, এবছর মে মাসে গড়ে বজ্রঝড়ের সংখ্যা ১৩’র আশেপাশে থাকবে বলে আশা করছি,” তিনি বলেন।

    তিনি আরও জানান, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।

    “ঘূর্ণিঝড় এবং বজ্রঝড় স্বাভাবিক সংখ্যক থাকলে এই মাসে গড়ে ২৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত থাকবে, এটি স্বাভাবিক। তবে বজ্রঝড় বা ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেশি হলে স্বাভাবিকতা ব্যাহত হবে।”

    এই মাসে তাপমাত্রা অনেকটা কমলেও দেশের কোনও কোনও অঞ্চলের ওপর তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে।

    “মে মাসে দুই থেকে তিনটা মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ হতে পারে। এবং, এক থেকে দুইটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হতে পারে। একটি তাপপ্রবাহ তো এ মাসের শুরুতে হয়েই গেল,” তিনি যোগ করেন।

    কিন্তু এই চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যেই সিলেট অঞ্চলে বন্যার পূর্বাভাসও পাওয়া যাচ্ছে।

    “সিলেটে যেহেতু গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, আর শুধু সিলেট নয়, ওখানে উপরের দিকে ভারতীয় অঞ্চলেও বৃষ্টি হচ্ছে,” সেজন্য বন্যার একটা শঙ্কা রয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নান।

    “যদি ক্রমাগতভাবে প্রতিদিন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়, তবে সাময়িকভাবে বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেজন্য পাঁচ দিন টানা বৃষ্টি হতে হবে,” বলেন এই আবহাওয়াবিদ।

    তবে তাপপ্রবাহের সময় ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া ও পর্যাপ্ত পানি পান করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না সাধারণ মানুষের। বন্যার সময়ও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

    তবে একটু সতর্ক হলেই বজ্রঝড়ের সময় প্রাণের ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।

    Getty Images গরমে বিপর্যস্ত শহরের নাগরিকদের জন্য বজ্রঝড় স্বস্তির হলেও প্রান্তিক মানুষের জন্য তা দুশ্চিন্তার কারণ। বজ্রঝড়ের সময় যা করণীয়

    বজ্রঝড় মানে তার সাথে বজ্রপাত থাকবে। প্রতিবছর বজ্রপাতে বাংলাদেশে অনেক মানুষ মারা যায়। তাই, বর্তমান আবহাওয়ায় বজ্রঝড় শহুরেদের জন্য স্বস্তির হলেও প্রান্তিক মানুষের জন্য তা দুশ্চিন্তার কারণ।

    বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে মে মাসে সর্বোচ্চ বজ্রপাত হয় এবং ২০২১ সালের এক হিসাব অনুযায়ী এতে প্রতিবছর গড়ে দেড়শো মানুষ মারা যান।

    সুতরাং, বজ্রপাতে মৃত্যু বা হতাহত হবার ঘটনা এড়াতে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

    • বজ্রঝড় সাধারণত ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করা। অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরা, এটি বজ্রঝড় বা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেয়।
    • বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে।
  • বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের ছাদে বা উঁচু ভূমিতে যাওয়া উচিত হবে না।
  • বজ্রপাতের সময় ঘরের বাইরের যে কোনো ধরনের খেলাধুলা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে।
  • খালি জায়গায় যদি উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ার থাকে, তার কাছাকাছি থাকা যাবে না। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকা বিপজ্জনক ।
  • বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ না ধরতে যাওয়া। সমুদ্রে বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া।
  • যদি কেউ গাড়ির ভেতর অবস্থান করেন, তাহলে গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ না রাখা।
  • READ ON APP