Hero Image

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হওয়ার কারণ কী?

Getty Images

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের আরও অবনমন ঘটেছে- এমন তথ্য দিয়ে গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) বলছে, বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যাদের নিশ্চিত করার কথা, সেই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দ্বারাই এটি বেশি হুমকির মুখে পড়েছে।

এই সুচকে ২০২৩ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৬৩তম।

তবে এবার বাংলাদেশ সেই অবস্থান থেকে দুই ধাপ পিছিয়েছে। এর ফলে এই সংস্থার মূল্যায়নে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থান আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বাকী সবদেশের নীচে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যদিকে গণমাধ্যমের মালিকানা কর্পোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াটা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সবমিলিয়ে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে 'একটা ভয়ের পরিবেশ' তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

যদিও বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বিবিসি বাংলাকে বলেছেন , আরএসএফ রিপোর্টের ক্ষেত্রে 'পদ্ধতিগত ও তথ্যগত' ভুল আছে। এছাড়া শনিবার ঢাকায় সম্পাদক পরিষদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন যে সরকার গণমাধ্যমের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করছে।

তবে আরএসএফ এর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের যে পাঁচটি ইনডিকেটর বা সূচক আছে তার মধ্যে গত বছর বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি অবনতির চিত্র উঠে এসেছে।

‘সরকারগুলো সাংবাদিকতার সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে’- এমন শিরোনামে আরএসএফ রিপোর্টের একাংশে বলা হয়েছে- সাংবাদিকতার জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো পরিবেশ তৈরির জন্য গ্যারান্টার হিসেবে যে ভূমিকা রাখার কথা সরকার ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সেই অঙ্গীকার পূরণ না করার প্রবণতাই বাড়ছে বিশ্বব্যাপী।

সংস্থাটি বলছে, অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তিগুলোই গুজব ছড়ানোকে উস্কে দিচ্ছে। অনেক দেশে সরকার সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রণ করে তথ্য ও সংবাদকে বাধাগ্রস্ত করছে।

প্রসঙ্গত, এ সূচকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকরা কতটুকু স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, সেটিই পর্যালোচনা করে দেখা হয়।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন: বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে

শুক্রবার ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ উপলক্ষে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকের ২০২৪ সংস্করণ প্রকাশ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স।

গণমাধ্যম সূচকের মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৭ দশমিক ৬৪। গত বছর তা ছিল ৩৫ দশমিক ৩১। সেবার অবস্থান ছিল ১৬৩।

এর আগে ২০২১ সালে ৫০ দশমিক ২৯ পয়েন্ট নিয়ে ১৫২তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।

রিপোর্টের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, দেশটির এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে এবং মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের প্রবেশাধিকার খুবই সীমিত। দেশটিতে সংবাদ ও তথ্যের জন্য ইন্টারনেটের ভূমিকা বাড়ছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে এতে।

রিপোর্টে বলা হ,য় স্বাধীনতার পর থেকে গণমাধ্যমকে সব সরকারই যোগাযোগের উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং তার দলের লোকেরা প্রায়শই তাদের অপছন্দের সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলা করেছে। একই সাথে নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিকের ওপর 'নীরবে বিচারিক হয়রানি' করা হয়েছে।

“এমন একটি প্রতিকূল পরিবেশে সম্পাদকরা সচেতনভাবেই সরকার যা বলে তাকে চ্যালেঞ্জ করাটাকে এড়িয়ে যাচ্ছে,” রিপোর্টে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, চলতি বছরের সাতই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকার যে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করেছে সেটি মূলত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টেরই একটি কপি মাত্র। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংস বাধা সৃষ্টি করেছে।

প্রসঙ্গত, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে আরএসএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একটি 'ড্রাকনিয়ান ল' হিসেবে আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করে এর বাতিল দাবি করে আসছিল।

ওই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে কারণ তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতার বিচার হয় না।

বাংলাদেশের অবনতির কারণ কী

বাংলাদেশের অবনতির কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন নানা ধরনের আইন, নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন ধরণের বিধিনিষেধের কারণেই বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জন্য কাজ করার পরিধি ক্রমশ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্র বা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশে যে ধরণের বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে তা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে। আবার তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে উল্টো হয়রানির মুখে সাংবাদিকরা পড়ছেন এমন অভিযোগও এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

বাংলাদেশে প্রেস ফ্রিডম পর্যবেক্ষণ করা সংস্থাগুলোর অন্যতম হলো টিআইবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কাজ করার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যে অবনতি হয়েছে এটা সবার কাছেই পরিষ্কার।

“এখানে আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও চর্চাগত- তিন দিক থেকেই পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সামনে ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্টের মতো আরও কিছু আইন আসছে যেগুলো গণমাধ্যম আরও চাপে পড়বে। সব মিলিয়ে গণমাধ্যমের জন্য একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে- এমন পারসেপশন এসে গেছে সবার মধ্যে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন তীব্র সমালোচনার মুখে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হলো। তবে এতে কোন পরিবর্তন আসেনি।

যদিও বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত শনিবার সম্পাদক পরিষদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন পেশাদার সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য আইন করা হয়েছে। এর কোন অপব্যবহার হলে তার বিরুদ্ধেই সরকারের অবস্থান থাকবে।

“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) মামলা করলেই জেলে নেয়া হতো। এখন সেটি নেই। সিএসএতে অপসাংবাদিকতায় কেউ যদি ভুক্তভোগী হয়, তারও সহায়তা চাওয়ার অধিকার আছে,” বলছিলেন তিনি।

অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলছেন, সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করলেও তা পরিস্থিতি উত্তরণে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি । যদিও গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই বেশি দায়ী করেন তিনি।

“মানুষের আস্থা নেই আইনশৃঙ্খলার ওপর নেই। পাশাপাশি সংবাদপত্রের মালিকানা চলে গেছে কর্পোরেট হাউজগুলোর কাছে এবং তারাই সব নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সর করছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতার পরিস্থিতিটাই আর সুস্থ নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তবে সম্পাদক পরিষদের অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন, 'অপসাংবাদিকতার চর্চা' মূল সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

“তথ্যের সঙ্গে অনেক সময় অপতথ্যের মিশ্রণ ঘটে। তাই সেখানে সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা আমরা করব,” বলেছেন তিনি।

এর আগে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন তথ্যের প্রবাহ এবং মুক্ত গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সরকার কোন বাধার সৃষ্টি করছে না। এছাড়া আইনের অপপ্রয়োগ যেন না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক আছে।

আরও খবর:

READ ON APP