Hero Image

শিয়রে যে শমন, রাজনৈতিক দলগুলো তা জানে?

মৃন্ময় চন্দ‘নিউট্রন বোম বোঝো/মানুষ বোঝো না’ —হেলাল হাফিজ, অশ্লীল সভ্যতা। ২০২৪-এর ‘ডুম্‌স ডে ক্লক’ মধ্যরাতের মাত্র দেড় মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে টিকটিক করে জানান দিচ্ছে ধরাধাম থেকে মনুষ্য-প্রজাতির বিলুপ্তির প্রহর সমাসন্ন। মনুষ্যকৃত যে সব কারণে পৃথিবীর বিনাশ প্রায় অবশ্যম্ভাবী বলে ‘ডুম্‌স ডে ক্লকের’ বিপদঘন্টি বাজানো, সেগুলি হল— এআই, পরমাণু অস্ত্র, ভূ-উষ্ণায়ন, সমুদ্রজলের উচ্চতা ও উষ্ণতা বাড়া, ফুটবল মাঠের সাইজ়ের কোনও গ্রহাণুর বেমক্কা পৃথিবীকে ধাক্কা মারা, সিনথেটিক বায়োলজির সৌজন্যে নতুন কোনও অতিমারীর সাড়ম্বর শুভাগমন এবং প্লাস্টিকের আত্মঘাতী ব্যবহার।
সব ক’টিই ‘গ্লোবাল ক্যাটাস্ট্রফিক রিস্ক’ (জিসিআর)। ‘জিসিআর’-এর সঙ্গে পাঞ্জা কষে একমাত্র রাষ্ট্রই পারে মানুষকে অভূতপূর্ব বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে। সে লক্ষ্যেই ‘ন্যাশনাল সিকিওরিটি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’, ইংল্যান্ডে, যে কোনও বিপর্যয় মোকাবিলায় ২০২১ সাল থেকে প্রাণপাত করছে। সুদূর দিগন্তে উঁকি মারা বিপদের সুলুকসন্ধানে তারা নিয়মিত ‘হরাইজ়ন রিস্ক স্ক্যানিং’ করে চলেছে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ এগ্‌জ়িস্টেনশিয়াল রিস্ক’ এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ‘ফিউচার অফ হিউম্যানিটি ইন্সটিটিউট’ জোর কদমে জিসিআর-জনিত বিপর্যয় মোকাবিলার পঠনপাঠন ও গবেষণা শুরু করেছে।
জিসিআর-এর দাপটের কথা বিবেচনা করে, উন্নত দেশগুলো সুবিস্তৃত পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতিও সেরে রাখছে। বিরাট অঙ্কের অর্থও তারা মঞ্জুর করছে। কিন্তু নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘জিসিআর’ সম্পর্কে একটা শব্দও কোনও রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে শোনা যাচ্ছে না। দুর্নিবার এআইমার্চ ৫, মঙ্গলবার। নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে শুরু হল ইউএসএ-র প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারি। ভোটের ঠিক দু’দিন আগে অসংখ্য মানুষের কাছে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট বাইডেন-এর একটি ফোন এল। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বাইডেন সাহেব বলে চলেছেন, ‘এই মঙ্গলবার আপনারা ভোট দিতে যাবেন না।
ভোট দিলে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার রাস্তাই প্রশস্ত হবে! নভেম্বরের ভোটটাই আসল, একটা ভোট নষ্ট না করে জমিয়ে রাখুন নভেম্বরের জন্য’। ২০০৪ সাল থেকেই নিউ হ্যাম্পশায়ার ডেমোক্র্যাটদের শক্ত ঘাঁটি। প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, বাইডেন-এর গলা হুবহু নকল করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-র সাহায্যে বানানো ‘রোবোকল’টির উদ্দেশ্যই ছিল ডেমোক্র্যাট ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরানো। কে বা কারা, এই ‘রোবোকল’টিকে ভোটের দু’দিন আগে বাজারে ছেড়ে ফায়দা লুটতে চেয়েছিল, আজ পর্যন্ত তা জানা যায়নি। ভারতের অবস্থা
ইউএসএ-র মতো বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিখরে অধিষ্ঠিত একটি দেশই যদি এআই-চালিত ‘রোবোকল’-এর ছলাকলায় ধোঁকা খেয়ে যায়, ভারতের অবস্থা কতটা শোচনীয় হতে পারে, তা অনুমেয়! ভোটের দু’দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর গলা নকল করে ভোটারদের কাছে যদি ফোনে আবেদন-নিবেদন আসতে থাকে যে তোমরা বাপু ভোটদানে বিরত থাকো, ভোট দিলেই বিপক্ষ দলের পৌষমাস আর তোমার সর্বনাশ, সাধারণ বুদ্ধি বলে, এমন অনুরোধ স্বকর্ণে শুনে আপ্লুত ভোটাররা তলিয়ে ভাবার চেষ্টাই করবে না যে এটা হতেই পারে ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার! প্রযুক্তিতে, ইউএস নির্বাচন দফতর ভারতের থেকে আলোকবর্ষ এগিয়ে।
ঢাল-তরোয়ালহীন ভারতের নির্বাচন কমিশন কী ভাবে যুঝবে তুখোড় এআই-এর বাঁদরামির সঙ্গে? সামান্য পয়সা ফেললেই জেনারেটিভ এআই-কে দিয়ে স্পর্শকাতর কোনও ঘটনাকে রং চড়িয়ে ‘ডিপফেক’-এর মাধ্যমে ভোটের বাজারে ভাইরাল করে চটজলদি কিছু ডিভিডেন্ড পকেটে ভরার ধান্দা করতেই পারে জাতপাত-ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা কিছু রাজনৈতিক দল! নির্বাচনের পারা চড়তেই শুরু হয়ে গেছে ভোটারদের প্রলোভন দেখানো। ভারতে ভোটারদের শিক্ষিত করারও কার্যক্রম নেই। সুতরাং এআই নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা আরও বেশি। এআই-এর চালিয়াতি
পশ্চিমি দুনিয়ায়, ভোটার তালিকা তৈরি বা পরিমার্জনে বেশ কিছুকাল যাবৎ ব্যবহৃত হচ্ছে এআই। সেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু-প্রান্তিক-বৃদ্ধ-প্রতিবন্ধী-বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের বেছে বেছে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছে এআই। বেশ কিছু গবেষণা দেখাচ্ছে এআই সাদা চামড়ার তুলনায় দুই থেকে চার শতাংশ বেশি কালো বা হিস্পানিকদের কোনও কারণ ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ছেঁটে ফেলছে (সায়েন্স অ্যাডভান্স, ভল্যুম-৭, ইস্যু-৮)। এআই মানুষের সংস্পর্শে থেকে শিখে নিয়েছে প্রান্তিক-সংখ্যালঘু-পঙ্গু-অশক্ত-দরিদ্র মানুষরা ভোটবাজারে মূল্যহীন।
২০১৬-তে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল ‘জেনারেটিভ প্রি-ট্রেনড ট্রান্সফর্মর’ বা চ্যাটজিপিটি, তার পর জিপিটি-টু, থ্রি, ফোর এবং ডাল-ই। মানব-মস্তিষ্কের সবচেয়ে কঠিন এবং ঘাম-ঝরানো কাজ— ভাষা শিক্ষা। শিশুর মন-মস্তিষ্কের বিকাশ, শিক্ষা এবং বেড়ে ওঠার মুলে থাকে ভাষা। ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ এবং নিউরাল নেটওয়ার্ককে প্রাণভোমরা করে মেশিন-লার্নিংয়ে ঠিক শিশুদের মতোই বিবর্ধিত-বিকশিত করা হচ্ছে এআই-কে। মানুষের যাবতীয় হীন গুণাবলিও ভাষার মাধ্যমে এআই-এর মস্তিষ্কেও সঙ্গোপনে চারিয়ে যাচ্ছে।
ভোটের দিন, এআই ‘রোবোকল’-এর মাধ্যমে ভোটারকে জানাতেই পারে কখন ভোটকেন্দ্র ফাঁকা রয়েছে, কোন রাস্তায় গেলে জ্যাম থাকবে না, পার্কিংয়ের সুবিধা কোথায় কতটা মিলবে বা দিনের কোন সময়ে ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা! সে সব বিষয়ে আলোকপাত দূরঅস্ত, উইসকনসিন-এর একটি ভোটকেন্দ্রের ভোটারদের দূরবর্তী একটি ভোটকেন্দ্রে পাঠিয়ে মজা লুটেছিল এআই। অতএব কোন অচেনা পথে নির্বাচনে সিঁধ কাটবে এআই—তা বোধ হয় ঈশ্বরেরও অজানা। এ দিকে মাইক্রোসফট সতর্ক করছে পড়শি চিনও নাকি এআইকে হাতিয়ার করে ভারতের ভোটে হুলুস্থুলু বাঁধানোর ফন্দি আঁটছে।
ব্রাত্য উষ্ণায়ন ও প্লাস্টিক‘ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি’ ২০২১ সালেই সাবধান করেছিল প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে বেঁধে রাখতে হলে নতুন করে একটিও গ্যাস বা তৈল-খনির দ্বারোদঘাটন করা চলবে না। এই সতর্কীকরণকে ফুৎকারে উড়িয়ে তেল এবং গ্যাসের উৎপাদন চার গুণ বাড়িয়ে, ২০২১ সাল থেকেই ২২টি দেশের ৪৫টা খনি থেকে ১৬০০ কোটি ব্যারেল অশোধিত তেল উত্তোলন শুরু হয়েছে। আমেরিকার গুয়ানার পরেই সবচেয়ে বেশি তৈলভান্ডারের হদিশ মিলেছে সাইপ্রাস-নামিবিয়া-জিম্বাবোয়েতে।
পুনর্নবীকরনযোগ্য শক্তির প্রভূত সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের দোহাই পেড়ে ভারতও আরও ঝুঁকে পড়ছে ফসিল-ফুয়েলের দিকে। গ্রিনহাউস গ্যাসের বাড়বাড়ন্তে বাড়ছে গ্রীষ্মের দাবদাহ, জলকষ্ট। গর্ভস্থ ভ্রূণে আকছার প্লাস্টিক অবশেষ মিললেও সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ মিলল ৫৮.৪% মানুষের শরীরে ‘ক্যারটিড আর্টারি প্ল্যাক’ বা ‘অ্যাথেরোমা’র কারণ হচ্ছে প্লাস্টিক—পলিভিনাইল ক্লোরাইড। তথাপি সরকার, জনসাধারণ বা বিরোধীপক্ষ হেলদোলহীন! ইস্তেহারে নেই অতিমারী কোভিডে ভারতের ভয়ঙ্কর অবস্থায়বিশ্ব আলোড়িত হলেও নির্বিকার সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারেবারে ভারত সরকারকে ‘ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজ়িজ়’-এ সর্বক্ষণের নজরদারির আধুনিক ব্যবস্থাপনার কথা বললেও কর্ণপাত করেনি সরকার। বিরোধী দলগুলোও অতিমারীর ভয়াবহতা বা তার নিয়ন্ত্রণের পন্থা সম্পর্কে নিঃস্পৃহ। আমেরিকার ৮টি রাজ্যে পোলট্রি বা পরিযায়ী পাখি থেকে লাফ মেরে বার্ড-ফ্লু গবাদি পশুর শরীরে ঢুকে পড়েছে। টেক্সাসের জনৈক মার্কিনি ‘হাইলি প্যাথোজেনিক অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা’ বা বার্ড-ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু গোরু-মোষ-ছাগলই নয়, ভালুক-নেকড়ে সহ এক ডজন বুনোও সে দেশে বার্ড-ফ্লুর খপ্পরে পড়েছে।
মঙ্গোলিয়াতে একটি ছোট জলাধারে পাখি-উট একসঙ্গে জলপানের সময়েই উটেরা বার্ড-ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। প্রমাদ গুনে সিডিসি বার্ড-ফ্লুর নজরদারিতে লাল-সতর্কতা জারি করেছে। ভোট ছাড়া, ভারত কেবল ঘুমায়ে রয়। পুনশ্চ: ভোট বানচাল করতে পারে ধরে নিয়েই সরকারকে এআই-এর বিরুদ্ধে কোমর-বেঁধে নামতে হবে। সজাগ-সচেতন হতে হবে ভোটারকেও। আখের গোছানোর ধান্দা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকেও কিঞ্চিৎ দক্ষ-শিক্ষিত বা ওয়াকিবহাল হতে হবে জিসিআর-এর ভয়াবহতা সম্পর্কে। না হলে বিপর্যয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। লেখক জিন-বিশেষজ্ঞ

READ ON APP