Hero Image

মোদীর ইশতেহারেও ছত্রে ছত্রে রেওড়ি সংস্কৃতি

প্রশান্ত ভট্টাচার্য এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, বিজেপি ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের ইশতেহার ঠিকঠাক। কথাটা হচ্ছে, নির্বাচকমণ্ডলী যদি একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহার বিবেচনা করেই ভোট দেয়, তবে বোধহয় আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয়বার একই ভোটারের সমর্থন পাওয়া উচিত নয়। সব রাজনৈতিক দলই সব স্তরের ভোটারের মনোরঞ্জনের জন্য নির্বাচনি ইশতেহারে নানান কিসিমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, কার্যক্ষেত্রে অষ্টরম্ভা।
এই নিরিখে দেখলে যে দল বা জোট ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, তাকে তো ভোটাররা মাফ করে দেন অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার কোনো দায় থাকে না। কিন্তু আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, সহজেই বলা যায় আমাদের দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর প্রায় ১০০ শতাংশই ইশতেহার বিবেচনা করে ভোট দেয় না, দেয় ভক্তিতে, আনুগত্যে, ভয়ে আর লোভে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো আগে-পরে কিছু রেয়াত না করেই প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। এই প্রসঙ্গে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের একটা কথা মনে পড়ে।
ওই রুশি নেতা বলেছিলেন, 'রাজনৈতিক নেতারা আপনার কাছে সেখানেও সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেবেন যেখানে আদৌ কোনো নদী বইছে না।' এবার আসা যাক ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনি ইশতেহার বা সংকল্পপত্রে। 'আজ দেশের একাধিক রাজ্যে নতুন বছরের শুরু। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিন। মা কাত্যায়নী পূজিত হন। আর মা কাত্যায়নী তাঁর দুই হাতেই পদ্ম ধরে থাকেন। আজ আম্বেদকরের জন্মদিন। কাকতালীয়ভাবে এমন বিশেষ দিনেই ইস্তেহার প্রকাশ করল বিজেপি।' 'কাকতালীয়'র মতো ডাঁহা মিথ্যে শব্দটা দিয়ে মোদী তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন৷ আমরা তো জানি, তিথি-নক্ষত্র না দেখে গেরুয়া শিবিরের মাতব্বররা বাহ্যত্যাগও করেন না।
ফলে, এসব অনেক ছকেই ঠিক হয়েছে। সাত দফার লোকসভা ভোটের প্রথম দফা ভোটগ্রহণ ১৯ এপ্রিল। সেই ছকেই তার ঠিক চারদিন আগে বাংলা নববর্ষের দিন ১৪ এপ্রিল নিজেদের ইশতেহার প্রকাশ করল মোদী-শাহর দল। প্রত্যাশামতোই বিজেপির ইশতেহারে ঠাঁই পেয়েছে এক দেশ এক ভোটের প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি ক্ষমতায় এলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রুপায়ণেরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বিজেপির তরফে। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা যদিও উপস্থিত ছিলেন আর আনুষ্ঠানিক ইশতেহার প্রকাশক তিনিই, কিন্তু যেখানে নরেন্দ্র মোদী হাজির থাকেন, সেখানে প্রচারের সব আলো মহাশূন্যের বিজ্ঞান মেনেই চলে।
বাকিরা ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। গত রবিবার সকালে দীনদয়াল মার্গের বিজেপির সদর দফতরের চেহারাটাও তাই হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই অনুষ্ঠানে জানান, এই সংকল্পপত্র যুব সমাজের ক্ষমতায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, গরিবের ক্ষমতায়ন আর কৃষকের ক্ষমতায়নকে সুনিশ্চিত করবে। তবে এগুলো 'জুমলা' না স্বপ্ন, সেসব নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। প্রথমেই বলি, বেশ কিছুদিন ধরেই এক দেশ এক ভোটের পক্ষে সওয়াল করছে বিজেপি। এনিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এনিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে রিপোর্টও দিয়েছে। তবে বিজেপির ইশতেহারে বিষয়টি ঠাঁই পাওয়া মানে এনিয়ে গুরুত্ব দিয়ে এগোতে চাইছে বিজেপি। সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সহ যেসব রাজ্যে কিছুদিন আগেই ভোট হয়েছে, সেসব রাজ্যের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়েও আপত্তির সুর শোনা গেছে দেশ জুড়ে। রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বাতিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু আর এক দেশ এক ভোট।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তথা বিজেপিরর দীর্ঘদিনের এই চার আজেন্ডার ২টি এরমধ্যেই পূরণ হয়েছে। এবার পালা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আর এক দেশ এক ভোট। এক দেশ, দুই নিশান, দুই বিধান হতে পারে না. বিজেপির এই সংকল্প দীর্ঘদিনের। সেটা পূরণ করতে বিভিন্ন বিজেপিশাসিত রাজ্য এরমধ্যেই স্থানীয় স্তরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করছে। এক্ষেত্রে সবার আগে রয়েছে উত্তরাখণ্ড। এবার নির্বাচিত হলে কেন্দ্রীয স্তরে সেটা করার ব্যাপারে ভাবা হবে বলে জানিয়ে দিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী। যেমনটা ভাবা গিয়েছিল তেমনটাই হয়েছে।
বিজেপির ইশতেহার এবারও মোদীময়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, 'মোদী কি গ্যারান্টি'ময়। গেরুয়া শিবিরের 'সংকল্পপত্র'র শিরোনামও এবার দেওয়া হয়েছে 'মোদী কি গ্যারান্টি।' বিজেপি মনে করছে, মোদী সরকারের ১০ বছরের সাফল্যের পর প্রধানমন্ত্রী জনমানসে যে আস্থা অর্জন করেছেন, তাতে 'মোদী কি গ্যারান্টি' শব্দবন্ধ ব্যবহার করলে মানুষের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে। তাই ৭৬ পাতার ইশতেহারের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর ছবি ৫৩টি।কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ মাত্র দু’বার। নেই বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি শব্দ দু’টি।
গরহাজির ধনী-গরিবের আর্থিক অসাম্যের প্রসঙ্গটি। এসবই মোদী-মাহাত্ম্য। তবে পদ্ম শিবিরের, সংকল্পপত্র'-এ আছে জিওয়াইএএন বা জ্ঞান-। কী এই জ্ঞান? বিজেপি বলছে সমাজের চার স্তম্ভের সার্বিক উন্নতি চায় তারা। সেই ৪ স্তম্ভ হচ্ছে জি-তে গরিব, ওয়াই-এ যুবা, এ-তে অন্নদাতা, আর এন-এ নারী। উল্লেখ্য, কংগ্রেসের ইশতেহারে যে ৫ ন্যায়ের কথা বলা হয়েছে, সেই ৫ ন্যায় থেকে সামাজিক ন্যায় বাদ দিয়ে বাকি ৪টিতেই ফোকাস করেছে গেরুয়া শিবির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এদিন ইশতেহার প্রকাশ করে বলেন, নারী শক্তি, যুবা শক্তি, কৃষক শক্তি ও গরিবদের উন্নয়নই মূল লক্ষ্য বিজেপির।
যাঁদের কেউ গুরুত্ব দেয় না, মোদী তাঁদের পুজো করে। এটাই বিজেপির 'সংকল্পপত্র'-এর আত্মা। এটা বিকশিত ভারতের সংকল্পপত্র। এই প্রসঙ্গে তেলেঙ্গানার কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডির সোজা কথা, বিজেপির বিকশিত ভারতের প্রচার আসলে ২০০৪-এ অটল বিহারী বাজপেয়ীর বিজেপির শাইনিং ইন্ডিয়া-র প্রচারের পুনরাবৃত্তি আর মানুষ সেবার যা করেছিল, এবারও তাই করবে, এই ভোটে বিজেপিকে খারিজ করবে। অন্যদিকে, বিজেপির ইশতেহারে বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির মতো শব্দ দু’টি উধাও কেন এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাহুল গান্ধী।
কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে অভিযোগ করেন, 'বিজেপির ইশতেহারে ও নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতায় দু’টি শব্দ গায়েব। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব। মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয় নিয়ে বিজেপি আলোচনাই করতে চায় না।' পাশাপাশি কংগ্রেস নেতুত্ব সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছে, কংগ্রেসের ইশতেহারে ৩০ লাখ সরকারি চাকরির ‘গ্যারান্টি’র কথা ছিল। বিজেপির সংকল্পপত্রে সেসব কিছুর বালাই নেই। কংগ্রেস মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজেপির ইশতেহারে এ নিয়ে টুঁ শব্দ নেই।
কৃষকদের দাবিমাফিক ফসলের ন্যূনতম দাম বা এমএসপি-র আইনি নিশ্চয়তার কথা বলেছে কংগ্রেস। বিজেপি এ ক্ষেত্রেও নীরব। কংগ্রেস সরকারি চাকরিতে মহিলাদের ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গরিব মহিলাদের বছরে ১ লাখ টাকা আর্থিক সাহায্যের কথা বলেছে। বিজেপির সংকল্পপত্রে এর কোনো প্রসঙ্গ নেই। মণিপুরে শান্তি ফেরানোর প্রশ্নেও বিজেপি নীরব। স্থানীয় মানুষের দাবি মেনে লাদাখকে কংগ্রেস ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে। বিজেপি এ নিয়ে কোনও কথা বলেনি। নরেন্দ্র মোদী বছরে ২ কোটি চাকরি, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা ও বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা উদ্ধার করে দেশে ফেরানোর কথা বলেছিলেন।
বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক আম আদমি পার্টির নেত্রী অতিশী অভিযোগ তুলেছেন, নরেন্দ্র মোদী বিজেপির ‘জুমলাপত্র’ প্রকাশ করেছেন। তিনি তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের কথা বলেছিলেন। ২০১৯-এ বিজেপির ইশতেগারেও সেই প্রতিশ্রুতি ছিল। গত নয় বছরে মোদী কোনো চাকরি দেননি। আইএলও-র রিপোর্ট অনুযায়ী স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন সবচেয়ে বেশি। দেশে বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত সকলেই। রান্নার গ্যাসের দাম ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০০ টাকা হয়েছে। ডিজেলের দাম ৫৫ টাকা থেকে ৯০ টাকা হয়েছে।
শুধু চিন্তা নেই মোদী-শাহ অ্যান্ড কোম্পানির।বিরোধীরা যেভাবেই সমালোচনা করুক, বাস্তবিক ২০১৪ সালে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদী দিল্লির মসনদে আসীন হয়েছিলেন, তার কতটা পালন হয়েছে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সময় বিজেপি সে বিষয়ে কোনো খতিয়ান তুলে ধরেনি। এখন ২০২৪-এ এসে বিজেপি ২০৪৭-এ ‘বিকশিত ভারত’-এর গল্প ফাঁদছেন! শুধু তাই নয়, ইশতেহারে বলা হয়েছে, ২০৩৬ সালের অলিম্পিক্স আয়োজন করবে। এ যদি গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল না হয়, তবে আর কী বলা যাবে! তবে এই সংকল্পপত্রে নরেন্দ্র মোদীরা নয়া জিনিস আমদানি করেছেন।
দুর্নীতি। নিজের বক্তৃতায় মোদীর কড়া বার্তা 'দুর্নীতি করলে জেলে থাকতে হবে।' আলবাত থাকতে হবে। কিন্তু 'সততার পরাকাষ্ঠা' প্রধানমন্ত্রী একবারও বললেন না, হিমন্ত বিশ্বশর্মা থেকে সর্বশেষ প্রফুল্ল প্যাটেলদের মতো গেরুয়া শিবিরে যোগ দিলে, নট কিচ্ছু, প্লেন ক্লিনচিট। সুইস ব্যাঙ্ক থেকে কালোটাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতির মতো এবারও মোদীর প্রতিশ্রুতি, 'নিয়োগ দুর্নীতি রুখতে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হবে।' একজন প্রধানমন্ত্রী যে এরকম দ্বিচারিতা করতে পারেন, তা নরেন্দ্র মোদীর সময়কালের মধ্য দিয়ে না গেলে আমাদের কারও অভিজ্ঞতা হত না।
ভাবা যায়, যে মোদী 'রেওড়ি সংস্কৃতির' কথা তুলে বিরোধীশাসিত রাজ্যে গিয়ে যখনতখন গাল পাড়তেন, তিনি এখন তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দুর্মর লোভে সেই 'রেওড়ি সংস্কৃতি'র চাষ করছেন। তাই বিজেপির ইশতেহারের ছত্রে ছত্রে সেই রেউরি সংস্কৃতি প্রতিফলন অধিক ঘোষণা করলেন মোদী সরকার ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দিচ্ছে। আরো পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার প্রকল্প চলবে। এটা মোদীর গ্যারান্টি। একইসঙ্গে বললেন আগামী পাঁচ বছর মনরেগা প্রকল্পের সুবিধা পাবে ১০ কোটি কৃষকও। আয়ুষ্মান ভারতে ৫ লাখ টাকা করে বিমা চলবে।
সত্তরোর্ধ্ব সব নাগরিককে এর আওতায় আনা হবে। আরো তিন কোটি লাখপতি দিদি তৈরি করাও মোদীর গ্যারান্টি। শুধু তাই নয়, এমনকী বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে। জনজাতি ভোট নিশ্চিত করতে, ২০২৫ সালকে 'জনজাতি গৌরববর্ষ' হিসাবে পালন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বিজেপির ইশতেহারে। (লেখকের নিজস্ব মতামতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি। 'এই সময় ডিজিটাল' এর দায়ভার বহন করে না।)

READ ON APP