Hero Image

ইশতেহারে রাজ্য এবং দেশ, একসঙ্গে দু'দিকেই নজর

প্রশান্ত ভট্টাচার্যমোদীর গ্যারান্টির পালটা দিদির শপথ। নিজের দেওয়া 'গ্যারান্টি'কে বাজি করে ভোট যুদ্ধে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উলটো দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ দফা শপথ নিয়ে তা পূরণের অঙ্গীকার করেছেন। লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর মাত্র দু"দিন আগে প্রকাশিত এই ইশতেহারকে তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে 'দিদির শপথ'।
মজার ব্যাপারটা হল, তৃণমূল একটি আঞ্চলিক দল, না, জাতীয় দলের তকমা হারিয়েছে বলে নয়, রাজনৈতিক শক্তির নিরিখেও তাই। কোনও পরিস্থিতিতেই দেশে সরকার গড়ার মতো শক্তি তার নিকট ভবিষ্যতেও অর্জন করার সম্ভাবনা নেই। তবু সেই দলটির নির্বাচনি ইশতেহারে কী দারুণ প্রতিস্পর্ধা। দেখা গেল এক মহীরুহর অঙ্গীকার। রাজ্য এবং দেশ, একসঙ্গে দুটি বিষয়কে সামনে রেখে নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশ করল তৃণমূল কংগ্রেস। দেশের জন্য তাদের পরিকল্পনার কথাগুলি 'ইন্ডিয়া' জোট ক্ষমতায় আসার পর বাস্তবায়িত করার কথা বলা হয়েছে।
ইন্ডিয়া জোট দেশে ক্ষমতায় এলে তৃণমূল তার শরিক হিসেবে কী কী করবে, সেই প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইশতেহারে। যদিও মমতা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় ইন্ডিয়া জোট নয়, তৃণমূল একাই লড়বে। গোটা দেশের ক্ষেত্রে কী হবে তা ভোটের পর দেখা যাবে। ইশতেহারে অবশ্য বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলে দেশে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী চালু করা। সিএএ, এনআরসি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বাতিল করা, প্রত্যেক বিপিএল পরিবারকে বছরে ১০টি গ্যাস সিলিন্ডার বিনামূল্যে দেওয়া, প্রত্যেক দরিদ্র পরিবারকে পাকা নিরাপদ বাড়ি, পেট্রোপণ্যের দাম কমানো-সহ মোট ১০টি শপথের কথা জানিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো।
বুধবার দুপুরে যখন মেট্রোপলিটনের তৃণমূল ভবনে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও'ব্রায়েন ও তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার প্রকাশ করছেন, মমতা তখন অসমের শিলচরে দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে জনসভা করছেন। সেখানে সিএএ- এনআরসির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে মমতা বলেন, তৃণমূল সরকারে এলে সিএএ, এনআরসি বাতিল করা হবে। সেই সঙ্গেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও কার্যকর হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
আর তৃণমূলের ইশতেহারেও এনিয়ে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হল। তার মধ্যে অন্যতম হল দিদির ৯ নম্বর শপথ। সেখানে বলা হয়েছে, স্বচ্ছ আইন স্বাধীন ভারত। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কে ধোঁয়াশাযুক্ত বলে আখ্যা দিয়ে তা বিলুপ্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মমতা। এনআরসি বন্ধ করা হবে। ইউনিফর্ম সিভিল কোড ভারত জুড়ে প্রয়োগ করা হবে না। উল্লেখ্য, গোড়া থেকেই এই ৩টি বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে তৃণমূল। আর এদিন এনিয়ে অমিত মিত্র জানিয়েছেন, তৃণমূল ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করার পরেই এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হবে।
এদিকে এবার মানে গত রবিবার প্রকাশিত বিজেপির ইশতেহার বা সংকল্পপত্র থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে 'এনআরসি'। যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে ২০১৯ সালের ইশতেহারে বিজেপি জোরের সঙ্গে দাবি করেছিল, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে ধাপে ধাপে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এনআরসি হবে। তবে ২০২৪ সালে সেই এনআরসি-র উল্লেখ করা হয়নি পদ্ম শিবিরের ইশতেহারে। অন্যদিকে, তৃণমূল ইশতেহারে স্পষ্ট জানিয়েছে, বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাতিলের জন্য বিল আনা হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নতির জন্য সাচার কমিটির বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়িত করা হবে।
সারি ও সারনা ধর্মের জন্য ধর্মীয় কোড তৈরির প্রস্তাবও রয়েছে। তৃণমূলের ইশতেহারের আবেদনে মমতা লিখেছেন, 'আমরা একত্রিত হয়ে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। একসঙ্গে আমাদের সব সংকল্প পূরণ করব। তৃণমূল কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা মাত্রই, এইসব প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকব।' 'দিদির শপথ'-এর মধ্যে রয়েছে, সব জব কার্ড হোল্ডারদের ১০০ দিনের গ্যারান্টি যুক্ত কাজ দেওয়া হবে। দেশজুড়ে শ্রমিকরা দৈনিক ৪০০ টাকার ন্যূনতম মজুরি পাবেন। দেশজুড়ে প্রত্যেক দরিদ্র পরিবারকে নিরাপদ ও পাকা বাড়ি প্রদান করা হবে।
প্রত্যেক বিপিএল পরিবারকে বছরে ১০টি গ্যাস সিলিন্ডারে বিনামূল্যে দেওয়া হবে। পেট্টোপণ্যের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল। 'দিদির শপথ'-এ বলা হয়েছে, পেট্রোল ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম সাশ্রয়ী মূল্যের সীমাবদ্ধ থাকবে। দামের ওঠাপড়া পরিচালনা করার জন্য 'ভাইস স্টেবিলাইজেশন ফান্ড' তৈরি করা হবে। গোটা দেশে কন্যাশ্রী ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল। আয়ুষ্মান ভারতের বদলে ১০ লাখ টাকার সুবিধাযুক্ত স্বাস্থ্য বিমা দেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে।
ইশতেহারে তৃণমূলের আশ্বাস, প্রতিমাসে প্রত্যেক রেশন কার্ড হোল্ডারকে ৫ কেজি করে রেশন বিনামূল্যে দেওয়া হবে। গোটা দেশে দুয়ারে রেশন চালু করা হবে। শিক্ষাখাতে দেশের বাজেট দেয় আড়াই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। তপশিলি জাতি, উপজাতি ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির যুবকদের উচ্চশিক্ষা বৃত্তি দেওয়া হবে। গোটা দেশে ৬০ বছরের উর্ধ্বে বয়স্কদের বার্ধক্য ভাতা বাড়িয়ে মাসে ১ হাজার টাকা করা হবে। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূলা প্রদানের আইনত গ্যারান্টি দেওয়া হবে।
২৫ বছর পর্যন্ত সব স্নাতক ও ডিপ্লোমাধারীদের ১ বছরের প্রশিক্ষণ ও বৃত্তি প্রদান করা হবে। কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর অধীনে নারায়ণী সেনা ব্যাটেলিয়ান তৈরির প্রস্তাব রয়েছে তৃণমূলের ইশতেহারে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ তুলে ইশতেহারে তৃণমূল জানিয়েছে, বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নেতৃত্বে সুশাসন বজায় থাকবে ও রাজ্য সার্বিক উন্নতির শিখরে পৌঁছোবে। এছাড়া বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা করা, নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা রোধ করা, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা পুনরুদ্ধার, সরকারি প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা ও মণিপুরে শান্তি ফেরানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।ঘাসফুলের ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে ৪৫ লক্ষ মানুষ বেকার।
এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের রিপোর্ট অনুযায়ী। তবে এখানে সব থেকে বড় দিদির শপথ হল, বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস। এদিকে দিদির শপথে রাখা হয়েছে—এক, বর্ধিত আয় শ্রমিকের সহায়। সেখানে সমস্ত শ্রমিকের আয় বাড়ানো হবে। দুই—দেশজুড়ে বাড়ি হবে সবারই। অর্থাৎ প্রত্যেকের মাথার উপর ছাদ তৈরি করে দেওয়া হবে। যা কেন্দ্রীয় সরকার কথা দিয়েও তা করতে ব্যর্থ হয়েছে মোদীর সরকার। আবাস যোজনার টাকা না পাওয়া থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিন—জ্বালানির জ্বালা কমবে, দেশের জ্বালা মিটবে।
অর্থাৎ বিনামূল্যে ১০টি রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার দেওয়া হবে বিপিএল গ্রাহকদের। যেখানে উজ্জ্বলা গ্যাস দিতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অন্যদিকে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখানে তুলে ধরা হয়েছে। দিদির শপথে রয়েছে চার—অনেক হয়েছে শাসন এবার দুয়ারে রেশন। প্রত্যেক গ্রাহককে পাঁচ কেজি করে রেশন তার দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া হবে। যাতে চাল, ডাল, শস্য থাকবে। আর খাবার নিয়ে চিন্তা থাকবে না। পাঁচ—আমাদের অঙ্গীকার নিরাপত্তা বাড়বে সবার। এই শপথে বলা হয়েছে কর্মসংস্থান নিশ্চিত থেকে শুরু করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সুরক্ষা দেওয়া হবে।
ছয়—বর্ধিত আয় নিশ্চিত এবার, ফুটবে হাসি অন্নদাতার। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হবে। তাও আইন মেনে। যা এখন দেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি তৃণমূল কংগ্রেসের।প্রতিশ্রুতি বা শপথ, যে নামেই ডাকা হোক, তা কতটা কার্যকর হয়, তা গবেষণার বিষয়, কিন্তু তৃণমূলের এবারের ইশতেহারের প্রথমেই তৃণমূল জানিয়েছে রাজ্য আইনসভাগুলির পরামর্শ মেনেই যাতে রাজ্যপাল নিয়োগ করা হয় সেজন্য ১৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদের সাংবিধানিক সংশোধন করা হবে। এই বিষয়টি খুব জরুরি ও তাৎপর্যপূর্ণ।
মোদী জমানায় বিরোধী শাসিত রাজ্যের রাজভবনগুলোকে যেভাবে বিজেপি অফিস করে তোলা হয়েছে, সেই বিচারে এই বিষয়টি ভাবার মতো। এই ইশতেহারেই বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করে তৃণমূল অভিযোগ করেছে বাংলার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য বাংলার রাজ্যপালকে হাতের পুতুল করে রাখা হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে মণিপুরে শান্তি স্থাপনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এরাজ্যে দুয়ারে সরকার কর্মসূচির মতো গোটা দেশে পরিষেবা প্রদানের জন্য 'ডোরস্টেপ' , কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে দলত্যাগ রোধে সংবিধান সংশোধন করে দলত্যাগ বিরোধী আইনের বিধানগুলি আরও সুস্পষ্ট ও কার্যকর করে তোলার কথা বলা হয়েছে। চালু করা হবে সরকারি খরচে নির্বাচনি প্রক্রিয়া।‌ যার ব্যাখ্যায় তৃণমূল জানিয়েছে, এর ফলে কালো টাকা এবং কর্পোরেটের আর্থিক সহায়তার প্রভাব হ্রাস হবে। রাজ্যের জন্য নেওয়া তাদের পরিকল্পনাগুলির মধ্যে একদিকে যেমন আছে 'দুয়ারে সরকার' ও 'পাড়ায় সমাধান' প্রকল্পগুলি নিয়মিতভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি তেমনই আছে ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা।
সেইসঙ্গে রাজ্যের নাম পালটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে 'বাংলা' করার দিকটিও উল্লেখ করেছে তৃণমূল। (লেখকের নিজস্ব মতামতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি। 'এই সময় ডিজিটাল' এর দায়ভার বহন করে না।)

READ ON APP